Welcome in my World

কৃষ্ণচূড়ার দিনগুলোতে

কৃষ্ণচূড়ার দিনগুলোতে

লেখক : নাজনীন পলি
রতনগঞ্জ থেকে একটি আমন্ত্রন পত্র এসেছে । আমাদের কলেজের অর্ধ শতবার্ষিকীতে যোগদান করার জন্য। কত বছর হল ওখানে যাওয়া হয় না । বন্ধুরা তো সব এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে , অনেকের সাথে যোগাযোগ নাই । আবার দাদাবাড়ি নানাবাড়ির আত্মীয়দের সাথেও দেখা হয়না । ভাবছি এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবনা ।
ঠিক হয়েছে আমি আমার গাড়িতে যাব যাবার পথে ছবিকে ওর বাসা থেকে তুলে নিব । কাল অনুষ্ঠান । আজ গাড়িতে বসে অনেক কথা মনে পড়ছিল ।

আমার আসার খবর রতনগঞ্জ জানানো হয়েছে । সবাই নিশ্চয় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে । নানাবাড়িতেও একবার যাব ভাবছি। নানাবাড়িতে গেলে আগে সবাই দেখতে আসতো । এখন ও হয়তো আসবে “ কই আমাগে সারার মাইয়ে আইছে শুনলাম , ও মনি তোমার মারে আননি ক্যা , কতদিন দেহিনি তারে, তুমাগে সাথে সাথে তোমার মাও শহুরে হয়ে গেছে , তোমার বর আর মায়েরে আননি , দেখতাম কিরাম হইছে ...” ইত্যাদি কত কথা বলবে । এদের কথার মধ্যে যে প্রানের টান তা ঢাকাতে আমি কোথায় পাবো ? ঢাকার শহরে সবাই অভিনেতা আর শহরটা একটি রঙ্গমঞ্চ । এখানে স্বার্থ ছাড়া কেউ শোক বা আনন্দ প্রকাশ করেনা। এখানে ভালবাসার বড়ই অভাব। এখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছ থেকে ধার করা সংস্কৃতি চর্চা হয় । ভালবাসা প্রকাশের দিবস, বন্ধুত্ব প্রকাশের দিবস আরও কত দিবস আছে । কেউ কেউ বলবে এসব দিবস পালনের ভালো দিক ও আছে ।

গাড়িতে বসে যখন এসব ভাবছি ছেদ পড়ল , ছবির ডাকে কী এত ভাবছিস রে ? ছবি স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকাতে থাকলেও ভাকেসন গুলোতে তার রতনগঞ্জ যাওয়া চাইই চাই ।এর কারণ ওর মাবাবা শ্বশুর শাশুড়ি ওখানে থাকে। ঈদ এ রতনগঞ্জ যাওয়া মানে ৬ ঘণ্টার পথ ১২ ঘণ্টাতে যাওয়া । কবে যে পদ্মা সেতুটা হবে ? মাঝে মাঝে আমিও ভাবি যাব গ্রামের বাড়িতে জার্নির কথা মনে পড়লে আর যাওয়া হয় না । আমার মেয়ে রিমঝিম খুব প্রকৃতি প্রেমিক । গাছপালা , নদী , পাহাড় , সমুদ্র এসব পছন্দ । ওর যেদিন জন্ম হল ওদিন ঝুম বৃষ্টি ছিল তাই ওর বাবা নাম রেখেছে রিমঝিম। খুব জেদ ধরেছিল আমার সাথে আসবে । ওর বাবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত তা না হলে দুজনকেই নিয়ে আসতাম ।একা ওকে সামলান মুশকিল হতো ভেবে আনলাম না । বাসাই দাদির কাছেই ভাল থাকবে । যদিও এখন মেয়েটার জন্য মন খারাপ লাগছে ।

এই মাত্র শোভন ফোন করলো আমরা কতদূর জানতে চাইলো । শোভন আর পিংকি আমাদের কলেজের নামকরা প্রেমিক জুটি ছিল , ওদের এখন দুই ছেলেমেয়ের সংসার । ও দের জুটিকে এখনও আমরা হিংসা করি । কলেজে যত গুলো জুটি ছিল তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশের প্রেম শেষ পর্যন্ত বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছিল । যারা বিয়ে করেছে তাদের মধ্যে সুখি হয়েছে কয়জন এ ও হাতে গোনা যাবে। আমার মুখে এ কথা শুনলে ওরা বলবে তুই আরেঞ্জ ম্যারেজ করেছিস তাই এসব বলছিস ।


বন্ধুদের অনেকেই দেশের বাইরে স্বর্গপুরিতে পাড়ি জমিয়েছে । রিমঝিম এর বাবা ও চেয়েছিল যেতে । আমার ইচ্ছা নাই । এখানে আছি এই ভাল । দাদাদাদি নানানানির আদর পাচ্ছে , দেশীয় সংস্কৃতি শিখছে । যখন উচ্চ শিক্ষার সময় হবে তখন দেখা যাবে । আমাদের বিয়েটা লেট মারেজ ছিল তাই তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেয়া ।আমার স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার।হ্যাঁ , একটা সময় ভেবেছিলাম কখনো বিয়ে করব না ।কিন্তু জীবনতো আর থেমে থাকে না; আসলে প্রকৃতিই আমাদের জীবনকে থেমে থাকতে দেয় না । রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটা খুব পড়তাম “ ভাল মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে। ” সত্যরে আমি নিয়েছি তবে খুব সহজে নয় । এর জন্য আমাকে মূল্য দিতে হয়েছে ।

ছবির ছেলেটা বমি করছে , আমার ও কেমন যেন মাথা ঝিম ধরে আছে । রাস্তাই একটা রেস্টুরেন্ট এ থামলাম । ঢাকা-যশোর রোডের চেয়ে বাজে রাস্তা হয়তো আর কোথাও নাই ।আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি ; রাস্তা খুব বেশি নেই আর। কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে যাব। নিজের মধ্যে উত্তেজনা অনুভব করছি ...। আমার জন্ম , বেড়ে উঠা প্রথম সব কিছুর সাক্ষী এই ছোট্ট শহর। সুমনের সেই গানটা মনে পড়ছে “ এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছুপিছু ...............।”

আমাদের বাড়ীটা অনেক বড় ছিল । দাদাদাদি, চাচাচাচি , চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনদের নিয়ে একটা যৌথ পরিবার । দোতলা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অপরুপা চিত্রা ।প্রতিদিন সাঁতার কাটতাম নদীতে । বাড়ির সামনে ছিল বিশাল এক উঠান সেটিকেই আমরা খেলার মাঠ হিসেবে চালিয়ে নিতাম আর ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়ানো । কত যে আনন্দ ছিল।উঠানে একটা বরই গাছ ছিল সেখানে আব্বা একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন । সেই বরই গাছটা এখন আর নেই । একবার আমার ভাই আমার জন্য বরই পাড়তে যেয়ে যেই না গাছে উঠে ঝাকি দিয়েছে অমনি একটি ইটের টুকরো আমার মাথাই এসে লাগে , অনেক রক্ত পড়েছিল । সেই কাটার দাগ এখনো আমার মাথাতে আছে । বাড়িতে সব ঘুরে ঘুরে দেখছি আর এক একটা স্মৃতি মনে পড়ছে । এমন লাগছে যেন শৈশবে ফিরে গিয়েছি । সব ছুঁয়ে দেখছি, গন্ধ নিচ্ছি্‌, আর আমার মেয়ের কথা ভাবছি ওর শৈশবটাও যদি এমন আনন্দময় হতো! ঢাকাতে আনন্দ কিনতে হয়, পার্কে উত্তেজক সব খেলনা থাকে বাচ্চাদের জন্য , ভিডিও গেম , সুইমিং পুল সব মেকি মেকি জিনিস । মাঠ , লেক সব এখানে মেকি।শপিং মলে যাও আর আনন্দ কেন । আমার বাসাও খেলনাতে ভর্তি , শুধু আমার কেন সব বাসারই একই অবস্থা । শহরের বাড়িগুলো একেকটা কবুতরের ঘরের মতন । আমাদের বাচ্চাদের জন্য সত্যি কিছু করা দরকার।

কলেজের অনুষ্ঠানে অনেকের সাথে দেখা বন্ধু , সহপাঠী , পরিচিতজন । সবার মাঝে বিশেষ একজনকে মন খুজে ফিরছে । যাকে পেলে অনেকদিন থেকে জমিয়ে রাখা একটা প্রশ্ন করতাম। কলেজ কাম্পাস এ অনেক কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল এখনও আছে । একটা পুকুর ছিল যেখানে জুটিদের প্রেম করার জায়গা ছিল। আর আমার ছিল অনিন্দ্য । আমাকে অনিন্দ্য অনেক বার বলেছে চলো ওখানে বসি , আমি রাজি হতাম না। আমি আবার বরাবরই ভদ্র ও শান্ত টাইপ। আমার ছিল বই পড়ার শখ তাই লাইব্রেরীতেই কাটাতাম বেশির ভাগ সময় ।আর অনিন্দ্য লাইব্রেরীতে যেত, আমাকে পাওয়ার জন্য । অনিন্দ্য হল সেই ছেলেটি যার কাছে আমার প্রেমের প্রথম পাঠ ।ও সবসময়ই আড়াল খুঁজতো; অপেক্ষা করতো কখন আমাকে একটু খানি ছোঁবে ।আমাদের নিয়মিত প্রেমপত্র বিনিময়, সুযোগ পেলে দু’জন মিলে কবিতা পড়া,আর পড়তে পড়তে অনিন্দ্যের একটু খানি ছোঁয়া কত যে মধুর ছিল ।

অনিন্দ্য আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছ কার কাছে যেন শুনলাম। ঢাকা থেকে রওনা হয়ার আগে পর্যন্ত ভেবেছি কাউকে কি জিজ্ঞেস করবো ও আসবে কিনা । মনের কথা মনেই রয়ে গেছে মুখে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। কৃষ্ণচূড়া দেখে খুব মনে পড়ছিল প্রথম সবকিছু তুমিই শিখিয়েছিলে , প্রথম কষ্ট টাও । তার আগে কষ্টের অনুভূতি আমার জানা ছিল না ।
সেই দিনের স্মৃতি এখনো জ্বলন্ত । আমার আঠারোতম জন্মদিনে তুমি আমাকে একটা উপহার দেবে বলেছিলে এবং তা তুমি দিয়েও ছিলে । আমাকে বলেছিলে কৃষ্ণচূড়া রঙের শাড়ি পড়তে । আমি কৃষ্ণচূড়া রঙের শাড়ি পড়ে এই কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি এসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললে,
তুমি কি জানো তুমি কত সুন্দর!
আজ থেকে তুমি নারী।
আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই,
নেবে ?
আমি শুধু হুম বলেছিলাম ।
অনিন্দ্য কম্পনরত হাতে আমার আঁচল টাকে সরিয়ে হৃদয়ের মাঝখানে চুম্বন দিয়েছিল।আর আমি কাঁপতে কাঁপতে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম । সেই স্মৃতি কোনদিন ভোলার নয় ।

ও আমেরিকা গিয়েছিল জ্ঞানী ও ধনী হবার লোভে । লোভ এতটা তীব্র ছিল যে মাঝ বয়সী এক মহিলা কে বিয়ে করে ওখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কৃষ্ণচূড়াকে সাক্ষী রেখে আমাকে দেয়া সব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলো ।
অনেক অনেক দুঃসময় পার করে এসেছি । এখন আমি সুখি অনিন্দ্য ।
শুধু তুমি যেখানটিতে চুম্বন করেছিলে সেইখানে একটা কাঁটা বিঁধে আছে।
তোমার সাথে দেখা হলে- চোখে চোখ রেখে জানতে চাইতাম, তুমি সুখি হয়েছো তো ?

No comments

Powered by Blogger.